Review From লেতুনজেরা নীলা

রিভিউ লেখার চিন্তা করতে গিয়ে এর আগে এতো বেগ পেতে হয়নি! কী লিখবো আর কী বাদ দেব এই ভাবতে গিয়েই দিশেহারা অবস্থা!
কথা বলছি এবারের বৈশাখের ছুটিতে টিজিবি'র সাথে কেওক্রাডং ট্রিপ নিয়ে...
কিছুদিন আগে মনিরা নওরোজ সেতু আপুর কেদারকান্তা টেকিং (সাদা পাহাড়) এর একটা ছবিতে চোখ আটকে গিয়ে মনে হলো, এই রকম একটা ছবি আমার তুলতেই হবে! আপুকে বললাম, "আপু, সাদা পাহাড়ে যেতে চাই।" আপু বললেন, "আগে দেশেরগুলো দিয়ে শুরু করো। এপ্রিলে বৈশাখের ছুটিতে কেওক্রাডং যাও..."
তো একটা সাদা পাহাড়ে যাওয়ার স্বপ্ন নিয়ে আমার কেওক্রাডং ট্রিপে যাওয়া...এটা ছিল আমার টিজিবি'র সাথে সেকেন্ড ট্রিপ। এর আগে মাত্র একটা ডে ট্রিপ দিয়ে টিজিবি'র অনেকেই ততোদিনে ভাই ব্রাদার হয়ে গেছেন! সেই সূত্রে, স্বয়ং ইমরান ভাই এবারের ট্রিপের হোস্ট জেনে একই সাথে স্বস্তি ও অস্বস্তি; দুইই বোধ হয়েছিল! স্বস্তির কারণ ছিল, নিরাপত্তা নিয়ে আর অস্বস্তি ছিল, উনার ছবি দেখে উনাকে আমার গুরু গম্ভীর মনে হয়েছিল! হিসাব করে কথা বলা, হিসাব করে চলাফেরা করা আরকি! কিন্তু আমার সব হিসাব নিকাশ একেবারে ট্রিপের শুরু থেকেই উল্টোপালটে গিয়েছিল!
আমি চারদিনের অফিস ট্যুর শেষ করে সোজা রংপুর থেকে ট্রিপে জয়েন করতে গিয়ে আধা ঘন্টা দেরীতে সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছাই! ততোক্ষণে সবাই পৌঁছে গিয়ে শুধু আমার জন্য সবাই অপেক্ষা করছিলেন! এ নিয়ে আমার লজ্জার সীমা ছিলোনা! অবশ্য পুরা ট্রিপেই আমি নিজে লজ্জা পাওয়ার বহুত কারণ তৈরী করেছি কিন্তু কী আশ্চর্য! কেউই লজ্জা পেতে দেয়নি!
যাই হোক, ইমরান ভাই বলেছিলেন, "দেরীতে কনফার্মড করেছেন, বাসে পেছনের সীটে বসতে হতে পারে। আর খাওয়া ঠিকমতন নাও পাওয়া যেতে পারে!" লোকটার কথার সাথে কাজের কোন মিল নাই! বাসে আমাকে সেকেন্ড সারিতে বসতে দিয়েছিলেন আর খাইয়ে খাইয়ে ওয়েট বাড়িয়ে দিয়েছেন! যদিও ট্রেকিং কথা মাথায় রেখে কোন বেলায় পেটপুরে খাইনি!
যাওয়ার সময় আমার পাশে ছিলেন হীরা আপা! কিন্তু বাসে যাওয়ার সময়ই সবাই ভেবেছিলেন, আমরা পুর্ব পরিচিত! কিছু বুঝলেন?? হীরা আপা, এবারের ট্রিপের বেস্ট ট্রিপমেটদের একজন! আমরা শুরু থেকেই প্রচুর "হ্যাভ ফান" করেছি আর একমাত্র আমরাই যারা যাওয়ার সময় বাসে এক ফোঁটাও ঘুমাইনি!
এই ট্রিপে এক আমি ছাড়া সবাই এক একজন বিশাল প্রতিভাবান! প্রতিভার প্রতি সম্মান জানিয়ে সক্কলেই গান, বাদ্য-বাজনা, কবিতা স্টাইলে গান, মারামারি স্টাইলে নাচ দেখিয়েছেন! তারপর ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে গেছেন! আমরা সাড়ে দশটায় রওনা দিয়ে বান্দারবন ভোর সাড়ে চারটায় পৌঁছে যাই! তারপর হোটেল ম্যানেজারকে ফোন করে হোটেলের গেট খুলে হোটেলে ঢুকি। এরপর ফ্রেশ হই, নাস্তা করি। তারপর বিভিন্ন পয়েন্টে চেকিং এর পালা শেষ করে বগালেক পৌঁছাই!
হু, লেকেই! এসেই নেমে পড়েছিলাম। আমরা বন্ড সই দিয়ে এসেছিলাম, নিজ দায়িত্বে সাঁতার কাটতে নেমে পানিতে ডুবে মরবো! আমি চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু ডুবে মরতে পারিনি, সাঁতার কাটতেই পারিনি! পানি খুবই ভারি! খুবই! এই ট্রিপে সাঁতার কাটতে না পারা ছিল আমার একমাত্র হতাশার কারণ!
প্রথম রাত বগালেকে! ভাবুন! সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১০৭৩ ফুট উপরে একটা লেকের পাশে রাত্রিযাপন! উফফ! ভাবতেই আমার এখনো শিহরণ হচ্ছে! জীবনে কত প্রাপ্তি! আমরা এবার চব্বিশজন ছিলাম! আমি সক্কলের হৃদয়ে কান পেতেছি! এই রাতে প্রত্যেকেই; কেউ নতুন স্বপ্ন তৈরী করেছেন, কেউ গল্প, কেউ কবিতা, কেউ কেউ জীবনের রসদ! এই রাত স্মৃতিময় হয়ে রবে সক্কলের জীবনে!
পরদিন সকালে উঠে নাস্তা করে কেওক্রাডং যাত্রা!
আমরা নেচে-গেয়ে, আরাম-আয়েশে স্বপ্ন আর কল্পনায় ভাসতে ভাসতে কেওক্রাডং পৌঁছে যাই! উঠতে কষ্ট লাগবেই তবে পৌঁছে যে তৃপ্তি পাবেন তা আপনার সব যন্ত্রণা নিমিষেই মুছে দিয়ে অসীম আনন্দে ভরিয়ে দেবে! পথে পাবেন চিংড়ি ঝর্ণা! দার্জিলিং পাড়া! খাবার পাবেন তেঁতুলের শরবত, পেঁপে, কলা! আর চোখে জুড়ানো অপার্থিব সৌন্দর্য্য! কখনো পাবেন জিরিয়ে নেয়ার জন্য জুমঘর, গাছের ছায়া! আর পুরোটা সময় আপনাকে সঙ্গ দেবে পাখির কলকাকলি! ভাগ্য খুব ভালো হলে দু'একটা সাপ বা বুনো কোন কিছুও পেয়ে যেতে পারেন। আমি একটা গিরিগিটির দেখা পেয়েছিলাম। (ছবিতে দেখুন)
কেওক্রাডং! আহা কেওক্রাডং! আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছেনা, এ পৃথিবীর মাঝে আমার যত পদচিহ্ন তার কিছু কেওক্রাডং এও!!
কেওক্রাডং এ যত যাই করুন, গোসল অবশ্যই করবেন! এক বালতি পানির দাম পঞ্চাশ টাকা! অনেক বড় বালতি। এক বালতিতেই হয়ে যাওয়ার কথা। আমি দুই বালতি নিয়েছিলাম। এখানে গোসল করে যে প্রশান্তি পাবেন...আমি আর কিছু না হোক, যদি আবার যাই, গোসল করার পরের যে প্রশান্তি সেটা নিতেই আবার কেওক্রাডং যাবো!
গোসল করে খাওয়ার পর বিকেলে বসে বসে প্রকৃতিকে উপভোগ করার পালা...যার যেমন মনে লয়! আমি কতক্ষন চুপ করে বসে থেকেছি...তারপর ছবি তোলা, আড্ডা মারা, হেলিপ্যাডে লাফালাফি...এর মধ্যেই মেঘেদের আনাগোনা আর ঝড়ের দোলাচলে ভেসে গেছি... অবশ্য ঝড় কী জানি কী ভেবে শেষ মুহুর্তে আছড়ে পড়েনি! তারপর রাতের খাবার খেয়ে আবার আড্ডা, গান আর টিজিবি'র কিছু নিজস্ব ইভেন্ট...মানে কে বেস্ট ট্রিপমেট ছিল, কে ভালো গান গায়...এরকম অনেক কিছু! ভাগ্য ভাল হলে বেস্ট সিঙ্গার বা এই রকম একটা কিছু নির্বাচিত হয়ে আপনার জীবনের মোড় ঘুরে যেতে পারে! আপনার লুকায়িত প্রতিভাকে টেনে হিঁচড়ে বের করার যে প্রতিভা তার তুলনা কেবল টিজিবি'রই!
রাতে আড্ডা শেষে আমরা মানে মেয়েরা রুমে ঢুকতে গিয়ে দেখি চাবি পাওয়া যাচ্ছেনা! (চাবি আমার কাছে ছিল! কেমনে হারায়েছি আমি জানিনা! সত্যি এমন লজ্জা পেয়েছি! এমন বেইজ্জতি মেলাদিন হইনি!) চাবি শেষমেশ পাওয়ায় যায়নি! আল্লাহ জানে কী ঘটেছিল চাবির! তবে তাতে আখেরে লাভ হয়েছিল! রাত তখন প্রায় দেড়টা...মেঘ এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে, দূরে দার্জিলিং পাড়ার টুকরো আলো নয়ন ভরিয়ে দিয়েছিল! পরে তালা ভেঙ্গে ঘরে ঢুকি! (কী থ্রিলিং! কী থ্রিলিং!)
অল্প কিছুক্ষণ গড়িয়ে নিয়েই আবার পাঁচটায় সূর্যোদয় দেখার জন্য উঠে পড়া...ভোরের কেওক্রাডং এর রুপ বর্ণনা করার ভাষা আমার অভিধানে নাই! শুধু ভোর কেন! কেওক্রাডং এর প্রতিটি প্রহর অনন্য! একেক প্রহরে এর একেক রুপ, একেক রস, একেক গন্ধ! ঝিম মেরে শুধু তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করতে পারলেই হলো!
ভোর দেখে সকালে ফেরার পালা...। সত্যি আমার মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল...অভিসার থেকে ফিরতেও মন এতো ব্যাকুল হয়না! কলিজায় মোচড় লাগেনা! যেন প্রেমিকের আলিঙ্গন ছেড়ে ফিরে আসা!
এবার সুর্যকে পেছনে ফিরে ফেরা...মুখে রোদ লাগেনা তাই ফেরা সহজ তবে শরীরে খুব ব্যালান্স রাখতে হয় আর লাগে গভীর মনোযোগ! পথে দার্জিলিং পাড়ায় নাস্তা করে এগারোটা নাগাদ বগালেক পৌঁছায়! তারপর আবার লেকে দাপাদাপি করে করে বান্দারবন! পথিমধ্যে , রুমায় দুপুরের খাওয়া!
ফেরার দিন ছিল পহেলা বৈশাখ! আদিবাসিদের পানি ছিটিয়ে ভিজিয়ে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের যে প্রচলন রাস্তার ফেরার পথে তা আমাদের উদ্বেলিত করেছিল! কেউ ভিজিয়ে দেয়ায় এতো আনন্দ লাগে আমি আগে বুঝিনি! বিকেলে বান্দারবনে বলিখেলা দেখাও হয়েছিল! তারপর রাতের খাবার খেয়ে রাতের গাড়িতে ভোর সাড়ে পাঁচটায় ঢাকা পৌঁছে যাই!
মানুষের প্রতি আমার যে দৃষ্টিভঙ্গী এই ট্রিপ তা বদলে দিয়েছে! ট্রিপমেট; সবাই এতো আন্তরিক আর হেল্পফুল ছিল, অবিশ্বাস্য! প্রত্যেকেই আমার কী প্রয়োজন, কী চাই; কী করে যে না বলতেই বুঝে গিয়েছিল ভাবলে অবাক লাগে! এরা প্রত্যেকেই আমাকে ঋণী করে ফেলেছেন! ভালোবাসার ঋণে ঋণী! সবচে বেশী ঋণী তামান্না আপুর কাছে! আমার মাইগ্রেন আছে! পুরো ট্রিপেই আমার ভয়ঙ্কর মাথা ব্যথা ছিল। আপু আমাকে পুরো ট্রিপেই উজ্জীবিত করে গেছেন! সুন্দর সুন্দর ছবি তুলে দিয়েছে মিষ্টি মেয়ে স্মৃতি! আর সক্কলেই আমার এই ট্রিপকে করেছেন স্মৃতিময়!
টিজিবি'র সাথে এই ট্রিপ ছিল অসাধারণ এক কাব্যগাঁথা!
টিজিবি একটা ভালবাসার নাম! টিজিবি একটা পরিবার! এটা এমন একটা পরিবার যেখানে সবাই ভাই-ব্রাদার, বইন-সিস্টার! এবং টিজিবি শুধু একটা ট্রিপ মেকারই নয়, টিজিবি প্রানশক্তি-তারুন্যে ভরপুর একটা গ্রুপ যারা আপনার বয়স বারো কী বায়ান্ন; সবাইকে এক কাতারে নামিয়ে বা উঠিয়ে আনার শক্তি রাখে! আপনার তারুণ্যকে টেনে বের করে করে এনে আপনাকে আনন্দের সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে আপনার ভ্রমণকে বিনোদনে ভরিয়ে দেবে টিজিবি!
আর ইমরান ভাই অতুলনীয়! আ রকস্টার! আ গ্রেট এন্টারটেইনার! এই মনে হয়, পাশের বাড়ির ছেলে, তো আরেকবার কলেজের বড় ভাই। আবার ভাববেন, না না তিনি ভার্সিটির সবচে কাছের ফ্রেন্ড!
যাই হোক, আপনি সিঙেল? আপনি নারী? আপনার বন্ধু নাই? পরিবার নাই? একা কোথাও যেতে পারছেন না? অথবা ভাবছেন, আপনার একটু বেশীই বয়স হয়ে গেছে কোথাও যাওয়ার জন্য? তাহলে টিজিবির সাথে ভ্রমণ করুন! সারা বছর জুড়ে অসংখ্য ইভেন্ট থাকে! শুধু আপনি কোথায় যেতে চান বেছে নিয়ে তাদের জানিয়ে দিন...তারপর আপনাকে ট্রিপে নিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব চোখ বুঝে তাদের হাতে দিয়ে দিন...আর নিশ্চিন্তে ভ্রমণ করুন!
সবশেষে, পরিবেশের প্রতি মানুষ সচেতন হচ্ছে। পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ট্রেকিং এ কোথাও তেমন একটা কিছু চোখে পড়েনি, এটা খুবই আশাব্যঞ্জক!


লেতুনজেরা নীলা
Traveller
26-May-2022