হুট করে বিশাল এক ঝর্ণার আবির্ভাব

হুট করে বিশাল এক ঝর্ণার আবির্ভাব, অনেকেই বাংলার নায়াগ্রা ফলস নামও দিয়ে ফেল্লো।
বলছি তিনাপ সাইতারের কথা।
খুব হার্ড-লাইফ রিস্কি কোন ট্রেক না, কিন্তু পরিস্থিতি সাপেক্ষে সেটাই যে অনেক সময় জীবন-যুদ্ধ জয় করার গল্প হয়ে দাঁড়ায় সেই গল্পই করছি আজ।
তিনাপ সাইতার যাবো, খুব এক্সাইটেড।
এমন সময় কল এলো মুশতাক ভাইয়ের। বলা বাহুল্য মুশতাক ভাই খুবই কাছের সুহৃদ, বড় ভাই সমতুল্য।
ভাবলাম ভাই যাবে তিনাপ, জমে ক্ষীর হয়ে যাবে।
কিন্তু ফোন দিয়ে বল্লো উনার বাবা মোফাক্কার আংকেল যাবেন। বয়স ৬৩-৬৪ এর মতন। বল্লো আব্বা যাবে বলসে মানে যাবেই, এখন তুই কিভাবে নিবি তুই দেখ, আমি আর কিছু জানিনা।
আংকেল কল দিলেন, বললাম যে টানা তিনদিন হাটা, এক্সট্রিম পাহাড় উঠা-নামা আছে আংকেল।
আমাকে একেবারে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে বললেন আমি ব্যাটা মুক্তিযোদ্ধা, গেড়িলা ট্রেইনিং করা মানুষ।
এখনো প্রতিদিন ৭-১০ কিলো হাটি-দৌড়াই। আমি যাচ্ছি, আমাকে নিয়ে চিন্তা করো না, বাকিদের সামলাও।
অনেকভাবে ডিমোরালাইজড করার চেষ্টা করেও ব্যার্থ হয়ে বললাম ট্রিপে কি কি নিতে হবে আর কি কি নেয়া যাবে না।
ওদিকে টুটুল ভাই, হাফিজ ভাই আর সুজন ভাইও যাবেন ট্রিপে। সম্ভবত ওটাই টুটুল ভাইয়ের প্রথম ট্রেক ছিলো, যদিও টুটুল ভাই এখন সারা পৃথিবীর বড় বড় মাউন্টেন চষে বেড়ান।
ট্রিপের বেশিরভাগ মানুষ ছিলেন কোন না কোন ভাবে পরিচিত কিংবা টিজিবির পুরাতন মানুষ।
আগুন বাহিনী নামে এক বাহিনী তৈরী হয়ে গেলো ট্রিপের শুরুর দিনই যেখানে ছিলো মিলন ভাই, কাদের ভাই, কিউট বয় ইমতিয়াজ, সামি, রুকাইয়া।
চুপচাপ আপু ফাতেমা আপু আর বিলু আপুও ছিলেন, পুরানো ট্রিপমেট। ফাতেমা আপু কথা বলেন না খুব একটা, শুধু হেসে যে কোন কথার রেসপন্স করেন।
জোরে হাসলে বুঝি জোকস ভালো হয়েছে, আওয়াজ ছাড়া হাসলে বুঝি যে এই জোকস উনার আগের শোনা।
অন্তরা আগে ট্যুর দিলেও আমার সাথে প্রথম ট্যুর, কিন্তু পূর্ব পরিচয় ছিলো। যার নাম দিয়েছিলাম টাটা ন্যানো! বাতাসের আগে দৌড়ায় টাটা ন্যানো গাড়ির মতন।
নতুন সদস্য ছিলেন পুলিশে কর্মরত রাকিব ভাই, উনার বন্ধু নুর আলম সহ কয়েকজন। প্রথম পরিচয়েই বেশ আন্তরিক মনে হলো টিম টা।
চাচাতো ভাই টিপু ছিলো, পোংটা বালক উপল ভাই ছিলো যার সেন্স অফ হিউমার দুর্দান্ত, সাথে ছিলো তিনাপের স্পেশাল হোস্ট নিশাত, যে বড় আর টাফ পাহাড় ছাড়া যায়না কোথাও।
মোটকথা জমে যাওয়ার মতন একটা বাহিনী।
প্রথমেই মোফাক্কার আংকেলকে খুঁজছিলাম, বাস স্ট্যান্ড এ পেয়ে গেলাম।
দুর্দান্ত লেভেলের ফিটফাট মানুষ, স্লিম ফিগার, হাস্যোজ্জ্বল চেহারা।
কাঁধে বিশাক এক ব্যাগ, কিন্তু নিয়ে সটাং দাড়িয়ে আছে।
যাক, কনফিডেন্স এর কারণ কিছুটা আঁচ করা গেলো।
বান্দরবান নেমে গাড়িতে করে রোয়াংছড়ি বাজার, তারপর ক্যাম্প এবং থানায় রিপোর্ট করে অনুমতিপত্র নিয়ে হাটা শুরু।
একটু হেটেই একটা ঝিরি পেলাম, আহা কি শান্ত-শীতল বয়ে চলা পরিস্কার পানি।
কিছুক্ষণ ঝিরি ধরে হেটে একটু পর গাইড জেমসন দাদা বললেন এর পর অনেক লম্বা পথে পানি পাওয়া যাবে না। ঝিরি থেকে পানি খেয়ে বোতল ভরে নেন।
বয়ে চলা ঝিরির মাঝে বোতল টা ধরে ঘাড়ের গামছাটা দিয়ে বোতলের মুখে ধরলাম যেনো ছোট পাথর বা বালির কণা ছেঁকে বোতলে পরিচ্ছন্ন পানি ঢুকে।
এবার অনন্ত যাত্রা শুরু।
ছোট-বড় পাহাড় উঠছি, নামছি।
ঘন্টাখানেক হেটে মোফাক্কার আংকেল দুর্বল হয়ে পড়লেন, আগাতেই পারছেন না।
উনাকে নম্র ভাষায় বললাম আংকেল, আগাতে না পারলে তো পুরো টিমের বিপদ হয়ে যাবে। আপনি চাইলে ব্যাকও করতে পারেন, অন্য গাইড দিয়ে পৌঁছে দিব বান্দরবান।
উনি বললেন যে না, আমি পারবো। হুট করে উঠছি তো, ঠিক হয়ে যাবে।
বললাম ব্যাগ টা আমাকে দেন, আপনি ফ্রি হাটেন, এতেও উনি রাজী হলেন না। ইগোতে লেগে গেছে সম্ভবত।
কি আর করা, আবার একটু হেটে আর পারছেন না, গামছা বিছিয়ে শুয়ে পড়লেন।
আবার বললাম ব্যাগ টা আমাকে দেন, এবার অমত করলেন না।
ব্যাগ টা কাঁধে নিয়ে আমি এক দিকে কাত হয়ে গেলাম। বললাম ব্যাগে কি আংকেল, এতো ভারি কেন?
বললেন তেমন কিছু না, যা দরকার বলেছিলে তাই এনেছি।
যাক, গাইডকে উনার সাথে থাকতে বলে আরেকজন গাইডকে সামনে পাঠালাম টিম লিড করার জন্য।
একটু এগিয়ে গিয়ে নিজেই কাহিল হয়ে পড়েছি, ব্যাগ এর ওজন মারাত্মক।
পোলাপান ও বলতেসিলো যে এই ট্রলির মধ্যে কি আছে ভাই, এতো ওজন। ব্যাগটা আসলেই ট্রলির মাঝে হাতা লাগানো টাইপ, উপরে আবার টানার জন্য হাতলও আছে যা টান দিয়ে বড় করা যায়!
সামি বল্লো খুলে দেখেন ভাই, আমিও ট্রলির মতন শেপের ব্যাগ টা খুললাম।
ভেতরে মনে হলো একটা সুপার শপ!
দুই কেজি খেজুর, ১ কেজি বাদাম, এক কেজি কিসমিস, ১০ প্যাকেট বিস্কুট, এক বক্স স্যালাইন, এক লিটার মিনারেল পানির ইন্ট্যাক্ট বোতল, ইউসুপগুলের ভুষির বক্স, নিউ কেয়ার ওয়েট টিস্যুর বড় প্যাকেট, চানাচুর এর প্যাকেট, কফির প্যাকেট....
সাথে আছে এক্সট্রা জুতা জোড়া, ৭-৮ টা টি-শার্ট, একাধিক প্যান্ট, ছোট প্যান্টের আলাদা চেম্বার সহ প্রয়োজনীয় আরো তৈজসপত্র!
সবাই একে অন্যের দিক তাকালাম।
নিশাত আবার মাসাজে উস্তাদ। ওরে বললাম কান্ধা ছিড়া পইড়া যাইবো, একটু ডইলা দেও।
দাড়িয়ে থেকেই হাত আর কাঁধ ইজি করে দিলো।
সব পোলাপান আগুন বাহিনী সমেত বিস্কুট, খেজুর, বাদাম, কিসমিস খেলাম যতক্ষণ পেট না ভরে।
তাও দেখলাম ট্রলির সিকিভাগও খালি হয়নি।
আবার কাঁধে নিলাম ট্রলি!
রাস্তায় যত স্থানীয় মানুষ পেলাম বা বাচ্চা পেলাম, সবাইকে পর্যায়ক্রমে খাবার বিলাতে বিলাতে আগালাম।
দুইদিন আংকেলের খাওয়ার জন্য যেটুক প্রয়োজন সেটুক হিসেব করে রেখেই বিলিয়ে মোটামুটি ব্যাগের ওজন অর্ধেকে নামালাম। আহ, কি আরাম!
একটা পাহাড় চূড়ায় দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখলাম। সূর্যাস্তের বিরতি দিলাম, যেহেতু পৌঁছাতে রাত হবেই, এই সুন্দর গোধূলি কেউ মিস করতে চাইলাম না।
জেমসন দাদারে জিজ্ঞেস করলাম আর কতক্ষণ হাটা লাগবে?
বল্লো দাদা, আর আধা ঘণ্টা!
বিকেল গড়ালো মাত্র, আর আধা ঘণ্টায় পৌঁছে যাবো ভাবতেই ভালো লাগছে।
অন্ধকার নামা শুরু হলো, একে একে সকলে টর্চ বা হ্যাডল্যাম্প জ্বালিয়ে নিলাম।
কোথাও জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হাটছি, কোথাও উঠছি-কোথাও নামছি।
আগের বার জিজ্ঞেস করার ঠিক এক ঘন্টা পর কাদের ভাই জিজ্ঞেস করলো আর কতক্ষণ?
দাদা বল্লো আর ১০ মিনিট।
আরো চল্লিশ মিনিট ট্রেক করার পর জেমসন দাদা ৫ মিনিটে নেমে এলেন।
যে আর পাঁচ মিনিট হাটলেই রনিন পাড়া, আমাদের আজকের গন্তব্য।
এই পাঁচ মিনিট ফুড়াচ্ছেই না।
রাত ১০ টা বেজে গেলো, দাদা বললেন আর পাঁচ মিনিট।
নিশাত একবার বল্লো "বস, গাইডে কি মশকরা করতেসে? দিমু নি ওরে একটা ডলা?"
দূরে একটা আলো দেখা গেলো, ভাবলাম পৌঁছে গেছি।
সেখানে ১৫ মিনিট হেটে পৌঁছে দেখি ওটা আর্মি ক্যাম্প, এখানে রিপোর্ট করতে হয়।
আর্মি ক্যাম্প থেকে আরো ১০-১৫ মিনিট হেটে রনিনপাড়া পৌঁছালাম।
পাড়া বেশ বড়। কপাল খারাপ থাকলে সাদা কাপড়েও রঙ উঠে শুনেছি।
পাড়ার একেবারে শেষ বাড়িই দাদার।
সেখানে পৌঁছাতে আরো গেলো ম্যালা চড়াই-উৎরাই।
যাক, ফাইনালি পৌঁছে গেলাম দাদার বাসায়।
গিয়েই ঢালাও বিছানায় শুয়ে পড়লাম সবাই ব্যাগ ছেড়েছুড়ে!
পাহাড়ে গয়াল ধরা পড়েছিলো, সেটা জবাই হয়েছে সেদিন।
এসেই দাদা নিজেই রান্না বসালেন।
রাতে গয়ালের মাংস, আলুর ভর্তা, ডাল আর ভাত পেট পুরে খেলাম সবাই।
সারাদিন এর হাটা, ক্লান্তি আর ক্ষুধা একসাথে লেগে আছে।কেকা ফেরদৌসির রান্নাও এখন বুর্জ আল খলিফার রান্নাকে হার মানাবে।
রাতে আংকেল এর কাছে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনতে চাইলাম, উনিও আসর সাজিয়ে বসে গল্প বললেন। মনে হচ্ছিলো আমরাও উনার সাথে যুদ্ধে আছি!
হুট করে বললেন ব্যাগে অনেক খাবার আছে, নিয়ে এসো। ব্যাগ খুলে দিলাম, উনি তো চেয়ে চোখ ছানাবড়া।
আমার দিকে তাকালেন।
বললাম ওই খাবারের ওজনেই আপনি শুরুতেই কুপোকাত হয়ে গিয়েছিলেন, আমিও কাঁধে নিয়ে আধমরা হয়ে যাচ্ছিলাম।
পরে রাতে আসরে তো খাওয়াতেনই, তাই আমরা পোলাপান মিলে ভাগ জোক করে খেয়েছি আগেই, আর পাহাড়ের মানুষজনকেও বিলিয়েছি।
জেমসন দাদাও খেয়েছে, কি দাদা খান নি?
দাদাও হেসে বলে "হা দাদা, অনেক খাইসি। অনেক মজা"!
হাফিজ ভাই এসে আবার দাবী তুলে গেলেন " ইমরান, আমরা কিন্তু পাইনাই। এটা অন্যায়, আমার ভাগের টা ঢাকায় গিয়ে খাওয়াতে হবে"!
বললাম এটা মোফাক্কার আংকেলের খাবার ছিলো, ঢাকা ফিরলে আংকেলই খাওয়াবেন তাহলে।
সকলের অট্টহাসির সাথে আংকেলও সুর মেলালেন নিরুপায় হয়ে।
সকালে হাটা শুরু খুব ভোরে, পাহাড়ের খাঁজে মেঘ দেখে সবাই বেশ আনন্দিত হলাম।
সকালের নাশতা ঝুড়িতে করে সাথে নিয়েছিলো দাদা, সেটাই এক ঝিরিতে বসে কলা পাতায় বেড়ে খেলাম। আহা, কি সেই অতি প্রাকৃতিক পরিবেশ, কি খাবারের স্বাদ।
তৎকালীন ডেড জোন নামে একটা খাড়া রাস্তা ছিলো, সেটা পেলাম। বেশ খাড়া বলা যায়, অনেকেই স্লিপ করে পড়েছে। বেশি পড়েছে বিলু আপু। উনি বার বার পড়ে আর আমার দিকে তাকিয়ে আঙ্গুল দিয়ে থ্রেড দেয় যে ঢাকা ফিরে খবর আছে। এমন একটা ব্যাপার যে আমি উনাকে ধাক্কা দিয়ে বার বার ফেলতেসি।
হাসতেসি আর মাফ চাচ্ছি।
অবশ্য সেই এক ট্রেকের পর বিলু আপুর সাক্ষাৎ আর পাইনাই, আগে জানলে এই ট্রেকে নিয়ে যেতাম না। আহা..
একটা জুমঘর পেয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার হাটা শুরু, পৌঁছে গেলাম স্বপ্নের তিনাপ!
পানির ফ্লো কম থাকলেও পানি ছিলো একেবারে স্বচ্ছ।
মন ভরে ক্লান্তি মিটালাম তিনাপের স্বচ্ছ জলে।
এবার আসল কাহিনি শুরু, গল্পের শুরুর দৃশ্যপটে থাকা মোফাক্কার আংকেল এবার খেলা দেখানোর পালা।
আগের রাতে গাইড মোটামুটি টেনে রনিনপাড়ায় নিয়ে এসেছিলো, সকালেও আংকেলকে বল্লাম সামনের পথ আজকের চেয়ে কয়েক গুণ খাড়া, উঠা বেশ টাফ হবে আজকের পরিস্থিতি বিবেচনায়।
উনি যাবেনই, নাছোড়বান্দা। ব্যাপার টা এক দিকে ইন্সপায়ারিং, অন্য দিকে তলে তলে হোস্টের বারটা বাজার উপক্রম।
তিনাপনামা শেষে পাহাড়ের আসল খেলা শুরু। একেবারে খাড়া পাহাড় যাকে বলে।
তবে ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে এই রুটে ট্রাক চলে। কাঠ আর পাথর নেয়ার ট্রাক।
এবার ১৫ মিনিট হেটেই মোফাক্কার আংকেল শরীর ছেড়ে দিলেন।
আংকেলকে কিছুক্ষণ হাত ধরে টেনে উঠিয়ে আমি নিজেই ক্লান্ত হয়ে গেলাম, পথ বেশ খাড়া।
টিমকে সামনের দিকে পাঠিয়ে টিপুকে সাথে রেখে দিলাম যে আংকেলকে একা সামাল দেয়া বেসামাল ব্যাপার হবে।
দুই ভাই মিলে আংকেলকে পিঠে ধরে টেনে আরেকটু উঠালাম।
ওদিকে বিকেল গড়াচ্ছে, উঠতেই হবে, কোন উপায় নেই। আবার রনিনপাড়াও ফিরে যাওয়ার উপায় নেই, ওইদিকেও এমন খাড়া পাহাড়। তিনাপ আসতে বেশিরভাগ পথই শুধু নিচে নামা ছিলো।
আংকেল পুরো শরীর ছেড়ে দিলেন মাঝ পথে এসে। মাটিতে এক প্রকার লুটিয়ে পড়লেন। বললেন যে বাবা, আমার পক্ষে আর এক কদম যাওয়া সম্ভব না। তোমরা চলে যাও, আমার জন্য মইরো না।
আমরা দুই ভাইও পাশে বসলাম, বললাম আমরা টেনে উঠাচ্ছি, আপনি সাহস রাখেন শুধু।
অনেক বুঝিয়ে রেস্ট করিয়ে দুইজনে এক প্রকার কোলে করে কিছুক্ষণ উঠালাম। এবার আমাদের শরীর ছেড়ে দেয়ার উপক্রম।
আংকেল আবার শুয়ে পড়লেন, এই খাড়া পাহাড়ে আসলে একেবারে কোলে করে বা টেনে কাওকে উঠানোর মতন এনার্জি ক্রিস গেইলেরও আছে কিনা জানা নেই!
আংকেল বুঝলেন অবস্থা ভয়াবহ দিকে যাচ্ছে, সন্ধ্যা আসন্ন প্রায়। আর সন্ধ্যা হলেই পাহাড় এক ভিনগ্রহ হয়ে যায়, এখানে সকল ক্ষমতা কিংবা চাওয়া নিস্তেজ হয়ে পড়ে।
আংকেল বললেন বাবা, আমার পক্ষে আর যাওয়া সম্ভব না। তোমরা একটা ভিডিও করো, আমি বলে দিচ্ছি আমার মৃত্যুর জন্য এরা দায়ী না, সব দায় আমার।
"মৃত্যু"!!
খট করে মোচড় দিয়ে উঠলো ভেতরে। কি বলে এসব, কি কঠিন শব্দ।
পরক্ষণেই ভাবলাম যে আর ঘন্টাখানেক পর সন্ধ্যা হবে, তারপর কি ঘটবে?
আংকেলকে নিয়ে এক কদমও এগোতে পারছিনা।
এমনি একটা ট্রাকের শব্দ শুনলাম, এই পথেই ট্রাক যায় শুনেছিলাম।
আংকেলও একটু নিচের দিকে তাকালেন।
একটু পর ট্রাক এলো কাঠ বোঝাই করে।
একেবারে ৪৫-৫৫ ডিগ্রি খাড়া রাস্তায় ট্রাক কিভাবে উঠতেসে এই হিসেব পরে মিলাবো, আগে আংকেলের ব্যবস্থা করতে হবে।
ট্রাকের লোকজনকে অনেক বুঝিয়ে রাজী করালাম, পরিস্থিতির ভয়াবহতা বুঝালাম।
বাধ সাধলেন আংকেল।
উনি প্রয়োজনে পাহাড়েই মারা যাবেন কিন্তু এই ট্রাকে উঠবেন না। এই ট্রাকে উঠলে নিশ্চিত মৃত্যু উনি দেখতে পাচ্ছেন।
জেনেশুনে আত্মহত্যা উনি করবেন না, এটা মহাপাপ!
কি ঝামেলায় পড়লাম।
আংকেলকে বোঝালাম যে একটু পর রাত হয়ে গেলে আমরা অসহায় হয়ে পড়বো।
গাইড হয়তো টিমকে পাড়ায় রেখে আমাদের খুঁজতে আসবেন, এসেও তো নিয়ে যেতে পারবেন না। সব মিলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে। এদিকে আবার ভেতরের লোকজনেরও প্রকোপ রয়েছে। বিপদ কত ধরনের আসতে পারে তার হিসেব নেই।
কিন্তু আংকেল নাছোড়বান্দা, উনি ট্রাকে উঠবেন না।
এবার বেশ রাগী গলায় ধমক দিতে হলো আংকেলকে। উনি বলেন তোমরা ভিডিও করে চলে যাও, এবার তো ট্রাকের লোক সাক্ষী, তোমাদের কেউ দোষ দিতে পারবে না।
টিপুও হতাশ হয়ে যাচ্ছে, ওদিকে ট্রাকওয়ালাও তাড়া দিচ্ছে, উনাদেরও যেতে হবে। আর এমন খাড়া পাহাড়ে গাড়ি দাড় করানো ঝুঁকিপূর্ণ , কোন কারণে চাকা স্লিপ করলে একেবারে খাদের নিচে।
আংকেলের এসব দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই।
উনি উঠবেনই না।
আমি পাশের জঙ্গল থেকে একটা লাঠি ম্যানেজ করে আনলাম, টিপু আর আমি প্ল্যান করেছিলাম কথা না শুনলে মাথায় হাল্কা বাড়ি মেরে অজ্ঞান করে উনাকে ট্রাকে উঠাবো।
মানে জীবন যেনো এক বাংলা সিনেমা।
আংকেল লাঠির দিকে তাকিয়ে রইলেন।
জোরাজোরি করে টেনে হিচড়েই বলা যায় উনাকে ট্রাকের সামনের সিটে তুললাম।
আংকেলের গামছা দিয়েই উনাকে সিটের সাথে বাঁধলাম।
সিট বেল্ট হিসেবেও বলা যায়, আবার বের হয়ে যেনো না যেতে পারে সে কারণেও বলা যায়।
আংকেল কিছুটা রাগত ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকালেন, আমি সাথে সাথে চোখ ঘুরিয়ে "এই টিপু, গাড়িতে উঠ তাড়াতাড়ি" বলে কাঠ বোঝাই ট্রাকের পিছনে গিয়ে বসলাম।
ট্রাক যখন উঠছিলো, আমি আর টিপু নিজেরাই বোকা হয়ে গেলাম। মনে হচ্ছিলো রকেটে বসে আছি আর রকেট সোজা উপরের দিকে উঠতেসে।
ট্রাকের ভেতর থেকে অনেক শোরগোল শোনা যাচ্ছে, ছোট একটা গ্লাস দিয়ে দেখা যাচ্ছিলো আংকেল মাথা নাড়ছে, হাওকাও করছে, কিন্তু এখন বারাক ওবামা বল্লেও গাড়ি ব্রেকের সুযোগ নেই। ড্রাইভার মামাকে আগেই বলেছিলাম উনি গালাগালি করলেও আপনি শুইনেন না, প্রয়োজনে নেমে আমাকে কয়টা গালি দিয়ে যায়েন।
এর মাঝে ট্রাকের পিছনে আমাদের সাথে বসে থাকা এক মুরুব্বী বললেন এখানে কি দেখতে আসছেন?
বললাম ঝর্না আর পাহাড়।
মুরুব্বী বিরক্ত হয়ে বললেন "বাপের টেকা নষ্ট কইরা বাওডান্ডি ঘুরাঘুরি খালি। বাড়িত গিয়া লেখাপড়া করেন গিয়া, নাইলে আমার মতন কাঠ কাইটা জীবন যাইবো"!
আমি আর টিপু দুজন দুজনের দিকে একবার তাকিয়ে বললাম " আচ্ছা কাকা, ভুল হইয়া গেছে। আর আসুম না বাপের টাকায়"!
গাড়ি থেকে নামলাম, কিছুক্ষণ পর বাকী টিমও আস্তে-ধীরে চলে আসলো।
মোফাক্কার আংকেল নেমে আমাকে আর টিপুকে জড়িয়ে ধরে বললেন "আংকেল, তোমরা না থাকলে আজকে আমার মরন নিশ্চিত ছিলো। তোমরা ছাড়া অন্য কেউ হলে হয়তো রাগ করে আমাকে ফেলেও চলে আসতো"।
মনে মনে বললাম যে আরেকটু হলে ৩ জন এক সাথেই মরতাম হয়তো।
পরে অবশ্য সবাই মিলে উনাকে উনার মানসিক শক্তি আর অদম্য ইচ্ছের জন্য স্যালুট দিয়েছি।
৬২-৬৩ বছর যদি বেঁচেও থাকি, উনার মতন এমন মনোবল, প্রকৃতির প্রতি প্রেম, সাহস ক'জনার থাকবে; আদৌ কারোই বা থাকবে কিনা কে জানে!
সেই সাথে এই যে সুন্দর দেশ টা ঘুরে বেড়াচ্ছি, এই দেশটা উনার মতন মানুষদের জন্যেই পেয়েছি আমরা।
রনিনপাড়ায় বসে উনার মুখে শোনা মুক্তিযুদ্ধের রগরগে গল্প আমাদের রক্তসঞ্চালন আরো বাড়িয়ে দিয়েছিলো বহুগুণ।
গাড়ি আসলো, গাড়িতে করে রুমা বাজার গেলাম।
যেতে যদিও রাত হলো, গিয়েই ব্যাগ রেখে ঝিরির পানিতে পুরো আগুন বাহিনী মন মতন ডুবালাম, গা ভেজালাম, আগুন নেভালাম।
তারপর ঢাকায় ফিরে আসা, তারপর এক ডায়েরি স্মৃতি জমাট হয়ে শেষ হওয়া একটি দুর্দান্ত ভ্রমণের.